গা কাঁপুনি দিয়ে আসা প্রচণ্ড জ্বর ও মাথাব্যথা কাটিয়ে উঠলেও শরীরের দুর্বলতা এখনো যায়নি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও তার ফলাফল নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণমূলক লেখার সুযোগও হয়ে ওঠেনি। সে লেখাটি শিগগির লিখব।
এই লেখা যখন লিখছি, তখন বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে শোকের আবহ। দীর্ঘদিন ব্যাংককে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে নিয়তির কাছে হেরে যাওয়া জনপ্রশাসনমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মরদেহ ঢাকায় এনে দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
একজন সৎ, পরীক্ষিত, ভদ্র, বিনয়ী ও সজ্জন রাজনীতিবিদ হিসেবে দল-মত নির্বিশেষে সবার সম্মান ও শ্রদ্ধা কুড়িয়ে তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানের নামাজে জানাজায় লাখো লাখো জনতার অশ্রুসজল নয়নে অংশগ্রহণ! এর চেয়ে আর বড় ভালোবাসা কী পাওয়ার আছে মানুষের? তিনি পেয়েছেন। তাই এ মৃত্যু বীরত্বের এবং মহত্ত্বের। কাফনে কোনো পকেট থাকে না। কোনো বিত্তবৈভব সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায় না। কর্মই নিয়ে যাওয়া যায়। কর্মই রেখে যাওয়া যায়।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হতাশাগ্রস্ত রাজনৈতিক সময়ে আশরাফুল ইসলাম একজন নির্লোভ, নিরহংকারী, সৎ ও সফল রাজনীতিবিদের ইমেজের ওপর উজ্জ্বল তারকার দ্যুতি ছড়িয়ে যে বিদায় নিয়েছেন, মানবকল্যাণের রাজনীতিতে এতেই তার নাম সোনার হরফে লেখা থাকবে।
বহুদিন পর রাজনীতিতে একজন ভালো মানুষের বিদায়ে অপূরণীয় ক্ষতিই হয়নি, ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জন্য মানুষের হৃদয় ও শ্রদ্ধা-সম্মান জয় করে রাজনীতিতে বিচরণ করার পথটিও দেখিয়ে দিয়ে গেলেন। প্রচারবিমুখ লাজুক প্রকৃতির এ মানুষটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও রাজনৈতিকভাবে জীবনের পরতে পরতে কঠিন মুহূর্তের মুখোমুখি হলেও নড়ে যাননি। প্রতিটি অগ্নিপরীক্ষায় বিচক্ষণতা ও সাহসের সঙ্গে, সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। আদর্শের প্রশ্নে নত হননি, অবিচল থেকেছেন। দলের দুবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। চারবার এমপি ছিলেন।
তিনবার মন্ত্রী ছিলেন। স্ত্রী যখন ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন, তখন পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছেন। সরকারের আনুকূল্য নেননি। লোভ-মোহ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি তার রাজনীতির ডিকশনারিতে ছিল নির্বাসিত। মন্ত্রী ও এমপি হিসেবে নেওয়া শপথ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। এ সততা, এ নির্লোভ চরিত্রের জন্য কখনো বাহাদুরি বা অহংকার দেখাননি। দলের প্রতি, আদর্শের প্রতি, নেতৃত্বের প্রতি ছিল নিঃশর্ত আনুগত্য। নিরাভরণ সাদামাটা জীবনে রাজনীতি ছিল তার কাছে পবিত্র ইবাদত। সমালোচনা সইতেন। পরমতসহিষ্ণু ছিলেন। মিডিয়ার প্রচারের কাঙাল ছিলেন না।
দলের সর্বশেষ কাউন্সিলে দেওয়া বক্তৃতা সারা দেশের নেতা-কর্মীদের হৃদয়েই নয়, কোটি মানুষের হৃদয়েও বিঁধেছে। বলেছেন, আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম। জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কারাগারে নিহত জাতীয় চার নেতাসহ লাখো নেতা-কর্মীর রক্ত দেওয়া, আত্মাহুতি দেওয়া এ সংগঠন। পৃথিবীর ইতিহাসে আত্মত্যাগে মহিয়ান আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দল নেই। পিনপতন নীরবতায় তার সেই বক্তব্য মানুষের হৃদয়ের তন্ত্রিতে তন্ত্রিতে ছড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পিতৃহারা সৈয়দ আশরাফকে বোনের স্নেহ-মমতায় কাছেই রাখেননি, হৃদয়নিসৃত ভালোবাসার বাঁধনে বিশ্বাসের রশিতে বেঁধেছিলেন। বোনের স্নেহের ঋণ আশরাফ তার কর্মেই শোধ করেছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরিবার থেকে যখন জানানো হয়েছিল, তিনি গুরুতর অসুস্থ, তখনো শেখ হাসিনা তার স্নেহের আশরাফকে মনোনয়ন দিয়েছেন। নিয়তির নিষ্ঠুর বিধান হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে বিজয়ী হলেও পঞ্চমবারের মতো এমপি হিসেবে শপথ নিতে পারেননি। ঢাকায় যখন তার প্রিয় দলের এমপিরা শপথ নিচ্ছেন তার বড় বোন নেত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন ঠিক তখন দুঃসংবাদটি এসে জানিয়ে দেয়, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
বিশ্বজয়ী বীরযোদ্ধা মহাবীর আলেকজান্ডার মৃত্যুশয্যায় তার সেনাপতিদের ডেকে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পর আমার তিনটি ইচ্ছা তোমরা পূরণ করবে। এক. আমার প্রথম অভিপ্রায় হচ্ছে, শুধু আমার চিকিৎসকরা আমার কফিন বহন করবেন। দুই. আমার দ্বিতীয় অভিপ্রায়, আমার কফিন গোরস্থানে যে পথে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথে আমার কোষাগারে সংরক্ষিত সোনা-রুপা, স্বর্ণমুদ্রা ও অন্যান্য মূল্যবান পাথর ছড়িয়ে দিতে হবে। তিন. আমার শেষ অভিপ্রায়, আমার কফিন বহনের সময় আমার খালি হাত কফিনের বাইরে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
তার মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত লোকজন মহাবীর আলেকজান্ডারের এ অদ্ভূত অভিপ্রায়ে বিস্মিত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে কেউ তাকে জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিলেন না। তখন তার একজন প্রিয় সেনাপতি তার হাতটা তুলে ধরে চুম্বন করে বলেন, ‘হে মহামান্য, অবশ্যই আপনার সব অভিপ্রায় পূর্ণ করা হবে, কিন্তু আপনি কেন এই বিচিত্র অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন? একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আলেকজান্ডার বললেন, আমি দুনিয়ার সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই।
আমার চিকিৎসকদের কফিন বহন করতে বলেছি এ কারণে যে, যাতে লোকে অনুধাবন করতে পারে, চিকিৎসকরা আসলে কোনো মানুষকে সারিয়ে তুলতে পারেন না। তারা ক্ষমতাহীন। আর মৃত্যুর থাবা থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম। গোরস্থানের পথে সোনাদানা ছড়িয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে এটা বোঝাতে যে, ওই সোনাদানার একটা কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। আমি এগুলো পাওয়ার জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছি, কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না। মানুষ বুঝুক ধন-সম্পদের পেছনে ছোটা সময়ের অপচয় মাত্র। কফিনের বাইরে আমার হাত ছড়িয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে এটা বোঝাতে যে, খালি হাতে আমি এ পৃথিবীতে এসেছিলাম, আবার খালি হাতেই এ পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি।
মহাবীর আলেকজান্ডার মৃত্যুশয্যায় যে শিক্ষা নিয়েছিলেন, আমাদের রাজনীতিবিদ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম রাজনৈতিক জীবনে সেই শিক্ষা নিয়েছিলেন। তাই শতভাগ সততার সঙ্গে সব লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে ওঠে মানুষের কল্যাণে তার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের আদর্শ বুকে নিয়েই রাজনীতি করেছেন। তিনবার প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। দুবার দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। চারবার এমপি ছিলেন। কিন্তু মানবসেবা করেছেন। কোনো পদ-পদবিকে ব্যক্তিগত লোভ-মোহ থেকে নিজের আখের গোছাতে ব্যবহার করেননি। কারও উপকার করতে না পারেন, কারও ক্ষতি করেননি। তিনি কোনো সম্পদ রেখে যাননি। তার সৃষ্টিশীলতা ও কর্ম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখে গেছেন। শূন্য হাতে এসেছিলেন। শূন্য হাতে ফিরে গেছেন। ৬৮ বছরের জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন।
রাজনীতির কঠিন সময়ে খেয়ে না খেয়ে থেকেছেন। কিন্তু অন্যায় ও লোভ-মোহের কাছে নিজের বিবেককে, মূল্যবোধকে বিসর্জন দেননি। কঠিনকে জয় করে, স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন। ক্ষমতায় থাকাকালে লোভ, দম্ভ, অহংকারকে নির্বাসনে পাঠিয়ে একজন আপাদমস্তক, পরিচ্ছন্ন, অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে সেবকের ভূমিকায় অনন্য অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। রাজনীতির ময়দানে পরিশীলিত, মার্জিত বাগ্মিতায় কাউকে আঘাত না করে শিষ্টাচারের সীমারেখার ভিতর থেকে কথা বলেছেন। এমন নেতা সাধারণের বেশে দিনদুপুরে মানুষের হৃদয়ে অনন্য সাধারণ হয়ে উঠেছেন। এই অনন্য সাধারণ রাজনীতিবিদ সৈয়দ আশরাফ তার কর্মেই ইতিহাসে অমরত্ব পাবেন। ইতিহাস ও মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন সম্মান-শ্রদ্ধা-ভালোবাসায়।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন